গরম হচ্ছে রাজনীতি: সর্বাত্মক ভোটযুদ্ধের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের

ডেস্ক রিপোর্ট • আরেকটি ‘ভোটযুদ্ধে’ নামার সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় দুই শতাধিক পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে এই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনের নিরঙ্কুুশ বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে কেন্দ্র থেকে।

এরই মধ্যে সারাদেশেই মাঠে নেমে পড়েছেন মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলীয় নেতারা। কেন্দ্রের সুদৃষ্টিতে থাকতে বা মনোনয়ন পেতে নানাভাবে লবিং-তদবিরেও নেমেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও ধানমন্ডির দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে পৌরসভা নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আনাগোনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এলাকায়ও পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতা জানান দিতে শুরু করেছেন অনেকেই। কয়েক ধাপে দেশের দুই শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী সপ্তাহে এসব নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা জানিয়ে রেখেছে। এর আগেই অবশ্য দেশের আরও পাঁচটি পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে আগামী ১০ ডিসেম্বর। এ ছাড়া আরও আটটি উপজেলা ও ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে একই সময়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ নিবন্ধিত প্রায় সব দল এসব নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
একযোগে দেশজুড়ে সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন হয়েছিল ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে তখন নিরঙ্কুশ বিজয় পায় সরকারি দল। ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে (একটি স্থগিত হয়) নৌকা প্রতীকে মেয়র পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগের ১৭৯ জন- যাদের মধ্যে সাতজন নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হন ২৫টি পৌরসভায়। এ ছাড়া ১৯টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী, একটিতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী, একটিতে জাতীয় পার্টি (জাপা), দুটিতে জামায়াত এবং ছয়টি পৌরসভায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হন।

ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতা জানিয়েছেন, ইসি তফসিল ঘোষণার পরপরই দলীয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ লক্ষ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমা নেওয়ার কাজও শুরু হবে শিগগিরই। প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর এবং প্রচারাভিযান শুরুর পর মাঠে নামবেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এবারও এ সময় কেন্দ্র থেকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করে দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, সামনে আসছে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এসব নির্বাচনে এখন থেকেই জয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। জয়ের জন্য যথাযথ প্রার্থী নির্ধারণের লক্ষ্যে সর্বসম্মত হতে হবে। তৃণমূলের প্রার্থীকে যাচাই-বাছাই করেই স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই বলব, শক্তিশালী ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবেন। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রার্থীর বিজয়ে কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা এবং দ্বন্দ্ব-কোন্দল সহ্য করা হবে না বলেও জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এবারের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি কৌশল নেওয়া হবে। সারাদেশে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের পাশাপাশি ত্যাগী ও দক্ষদেরই মেয়র পদে প্রার্থী করা হবে। অপকর্মে যুক্ত, বিতর্কিত কিংবা অনুপ্রবেশকারী এমন কাউকেই প্রার্থী করা হচ্ছে না। ১০ ডিসেম্বরের পাঁচ পৌরসভা নির্বাচনসহ আটটি উপজেলা পরিষদ ও ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের সময় এই কৌশলের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। আসন্ন দুই শতাধিক পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও একই নীতি অব্যাহত থাকবে।
এদিকে ‘বিব্রতকর পরিস্থিতি’ এড়াতে তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকার বাইরে কাউকে পৌর মেয়র প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে নেতারা জানান, সাম্প্রতিক সংসদীয় উপনির্বাচনগুলোসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বেলায় দেখা গেছে, প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা ও বিধিনিষেধ না থাকায় যে যার মতো করে মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েছেন। ফলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনসহ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রায় সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলে ‘প্রার্থী বিস্ম্ফোরণ’ ঘটে। দলীয় পদ-পদবিতে নেই এবং জনগণের কাছে অপরিচিত, এমন অনেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়ে দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও ঠেলে দেন। গত ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ৫৮ জন- যা ক্ষমতাসীন দল সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনারও জন্ম দেয়। এ অবস্থায় সম্প্রতি কেন্দ্র থেকে পাঠানো নির্দেশনায় এর পর থেকে তৃণমূলের পাঠানো তালিকার বাইরে কারও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় পাঁচটি পৌরসভা নির্বাচন থেকে দলের এই নীতি কার্যকর করা হয়েছে।

বরাবরের মতো এবারের পৌর নির্বাচনেও ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ ঠেকাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। যদিও গত কয়েক বছরের নির্বাচনগুলোতে দল থেকে বহিস্কার করাসহ নানা সাংগঠনিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েও বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা রোধ করা যায়নি। নানা প্রচেষ্টার পরও ২০১৫ সালে ২৩৪টি পৌরসভার ৮০টিরও বেশিতে দলের তৃণমূল নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থিতার আড়ালে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯ বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেও যান। এ কারণে এবার নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ দমনের বিষয়টিতেও সর্বাত্মক ও বিশেষভাবে ‘নজর রাখা’ হবে- এরকমই জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা।

নেতারা আরও বলছেন, সারাদেশে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে একক প্রার্থী নিশ্চিত করা দলের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। তাই এবার নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিরোধ দূর করার প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চালাবেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এত কিছুর পরও কেউ সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া, যেমন আজীবনের জন্য দল থেকে বহিস্কারের হুঁশিয়ারির কথাও বলছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের জনপ্রিয়, সাংগঠনিক এবং দায়িত্ব পালনে সক্ষম- এমন নেতাদেরই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা বিতর্ক রয়েছে, যারা অনুপ্রবেশকারী- তারা মনোনয়ন পাবেন না।

দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ইতোমধ্যেই তৃণমূলে পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তৃণমূল থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নামের তালিকা কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়েছে। মনোনয়ন বোর্ড এ তালিকা থেকেই প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ গেলে তার বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।